মোঃ দবিরুল ইসলামঃ ১৯৫২ সালের মাতৃভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র বিশ্ব মানচিত্রে অভিভূত হয়। এই ভাষা আন্দোলনের রয়েছে বিস্তৃত ইতিহাস। আমার লেখায় ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা ও সে সময়ে বঙ্গবন্ধুর কারাগারের করুণ কষ্টের চিত্র জাতিরপিতার অসমাপ্ত আত্নজীবনী অবলমম্বে তুলে ধরার ক্ষুদ্র প্রয়াস মাত্র।ব্রিটিশ শাসনামল থেকে মুক্তি পেয়ে দ্বিজাতি তত্বের ভিত্তিতে বিভক্ত দুটি নতুন রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান। পাকিস্তানকে দুটি নামে পরিচিতি পায় পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান। পাকিস্তানের সংখ্যাগোষ্ঠী জনগণের মুখে ভাষা ছিল বাংলা ভাষা।
১৯৪৮ সালে ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ভাষণে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন উর্দুই হবে সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা। প্রথম সারিতে বসা আইনের ছাত্র বঙ্গবন্ধু দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেন। শুরু হল মাতৃভাষার জন্য আন্দোলন।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশ মাটি ও মানুষের জন্য অসংখ্য বার জেলে গেছেন। ভাষা আন্দোলনের শুরুতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেলখানায় বন্দি ছিলেন তারপরেও সংগঠিত করেছেন ভাষার জন্য সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ ও নিজেও করেছেন আমরণ অনশন ধর্মঘট।
১৯৫২ সালে ২৬ জানুয়ারি পল্টনের এক জনসভায় ১৯৪৮ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নার পর আবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন ঘোষণা করলেন “উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা”। বাংলার জনগণ ক্ষোভে ফেটে যাচ্ছেন তখন একমাত্র রাজনীতিক দল ছিল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলীগ,ছাত্রদের প্রতিষ্ঠান ছাত্রলীগ এবং যুবদের প্রতিষ্ঠান যুবলীগ। তারা সকলেই তীব্র আন্দোলন শুরু করলেন। আর এদিকে জেলখানায় বন্দি অবস্থায় জাতির পিতার চোখের ও হার্টের সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করলে ভর্তি করা হল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। হাসপাতালে কেবিনে থাকা অবস্থায় বিকাল চারটা থেকে ছয়টা পর্যন্ত সবাই দেখা করতে পারতেন। আওয়ামীলীগ,ছাত্রলীগ ও যুবলী্গের অনেক নেতারা দেখা করতে আসতেন। ভাষা আন্দোলনের জন্য গোপনে গোপনে সংগঠিত করা হল। ছাত্রলীগ নেতারা রাতে গোপনে দেখা করতেন। একদিন বিশেষ অনুমতি নিয়ে দেখা করলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আতাউর রহমান। ছাত্রলীগ এর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে ছাত্রলীগ নেতারা অনেক শ্রদ্ধা করতেন। সবাইকে বললেন বৈঠক করেন সর্বস্ত্ররের জনগণকে সম্পৃক্ত করে গঠন করেন সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ ,সেখানে কনভেনার হবে ছাত্রলীগ থেকে, গঠন হল সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ। সিদ্ধান্ত হল ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন দিবস পালন করা হবে । কারণ ঐ দিন পূর্ব পাকিস্তানের আইন পরিষদের অধিবেশন বসবে। আর জাতির পিতা সিদ্ধান্ত নিলেন ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে নিজের কারা মুক্তির জন্য আমরণ অনশন ধর্মঘট পালন করবেন।
সরকার জানতে পারলেন বঙ্গবন্ধু হাসপাতাল থেকে রাজনীতি করছেই। তাকে নেওয়া হল ঢাকা জেলে, সেখান থেকে গোপনে নেওয়া হল ফরিদপুর জেলখানায়। যথারীতি জাতির পিতা ১৬ তারিখ থেকে শুরু করলেন অনশন ধর্মঘট। জেল কর্তৃপক্ষ অনুরোধ করলেন অনশন না করতে। তিনি বললেন,আর কত? ছাব্বিশ-সাতাশ মাস বিনা বিচারে বন্দি আছি আর কত দিন ? তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি ” Either I will be go out of the jail or my dead body will go out” । দেশে শুরু হল ভাষা আন্দোলন। কয়েক দিন পর তিনি খুবই অসুস্থ হয়ে পরলেন। তারপরেও তিনি কিছু খেলেননা। ২১ ফেব্রুয়ারি দিনে অনেক উদ্বেগ ও উতকন্ঠায় কাটল রাতে যখন চিন্তিত ছিলেন সেসময় সিপাহি এসে বললেন ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে, পুলিশ গুলি করেছে অনেক ছাত্র মারা গেছে। সালাম,রফিক, শফিক, জব্বারসহ নাম নাজানা অনেকেই শাহাদাত বরণ করেছেন। সেই রাতে বঙ্গবন্ধু এই চিন্তা করে ঘুমাতে পারে্ননি, ক্ষোভে ফেটে যাচ্ছেন। তাকে জোর করে খাওয়ানো চেষ্টা করা হল কিন্তু কিছু খেলেননা। বঙ্গবন্ধু সামনে ডাব,শরবত, পানি, ফলমূল,,, ও বিভিন্ন ভাল মানের খাবার রাখা হল তারপরেও তিনি কিছু খেলেননা। তারপর নাকের ভিতর নল দিয়ে পেটের মধ্য পর্যন্ত নিয়ে যায়। সেখানে কাপের মধ্য দুধের মত পাতলা করে খাবার দেয়। একজন স্বাভাবিক মানুষের জন্য তা কতটা যন্ত্রণাদায়ক হতে পারে। দুই তিন বার পাইপ ঢুকানোর ফলে তার নাকের মধ্যে ঘা হয়। শেখ মুজিব ব্যথায় কাতর হয়ে যাচ্ছেন তার পরেও হাতে হেন্ডকেপ লাগিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করা হয়। ২৭ ফেব্রুয়ারি সিভিল সার্জন শেখ মুজিবকে দেখে চিন্তায় পরলেন, ক্রমেই মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধু । নিশ্চিত মৃত্যু ভেবে অন্য কায়েদীদের সহায়তায় অজু- গোসল সেরে দোয়া ও তওবা পড়তে লাগলেন। আর দেশ ও পরিবার আব্বা,আম্মা, হাচিনা(বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী), কামাল আর রেনুর কথা ভাবেন। জাতির পিতা ভাবেন আমি মারা গেলে রেনুর কি হবে? তারতো পৃথিবীতে কেউ নাই। শক্তিবল কিছু নাই কথাও বলতে পারেনা। আর বঙ্গবন্ধু এইটুকু ভেবে শক্তি পাচ্ছেন দেশের জন্য মারা যাচ্ছেন।
আমি যখন অসমাপ্ত আত্নজীবনীতে এই ঘটনাগুলো পড়তেছিলাম তখন আমার গায়ের লোম দাড়াই যায়, চোখ পানিতে টকবক করে। একজন ব্যক্তির মধ্যে কি পরিমান দেশ প্রেম থাকলে এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন?
একদিকে মাতৃভাষার জন্য আন্দোলন অন্যদিকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য জনগণ এর আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হল। অবশেষে ১৩ দিন অনশন ধর্মঘট পালন করার পর মুক্তি পেলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমরা পেলাম মায়ের ভাষা, ১৯৫৪ সালে ৭ মে মুসলীমলীগের সমর্থনে পাকিস্তানের গণপরিষদে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলা রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে মর্যাদা লাভ করে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় স্বাধীন বাংলাদেশের আর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, নেতা থেকে হলেন অবিসংবাদীত নেতা।
সালাম হে পিতা সালাম।
যাদের আত্নত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি মায়ের ভাষা ও স্বাধীন দেশ । তাদের সকলকেই জানাই গভীর শ্রদ্ধা ও তাদের বিদেহী আত্নার মাগফিরাত কামনা করি।
আসুন আমরা তাদের ত্যাগের মহিমাময়ে উদ্ভাসিত হয়ে বুকে লালন করে আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা রাখি।

মোঃ দবিরুল ইসলাম