টঙ্গীর তুরাগ নদের পূর্ব তীরে বিশ্ব মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় বৃহত্তর ধর্মীয় সমাবেশ বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব শনিবার (১১ জানুয়ারি) শতাধিক যৌতুকবিহীন বিয়ের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে। ৪ বছর পর বিশ্ব ইজতেমায় এবার যৌতুকবিহীন বিয়ের আয়োজন হয়। রোববার জোহরের নামাজের আগে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে। মাঝে ৪দিন বিরতির পর আগামী ১৭ জানুয়ারি থেকে শুরু হবে ৩ দিনব্যাপী বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব। আগামী ১৯ জানুয়ারী আখেরি মোনাজাতের মধ্যে দিয়ে শেষ হবে ২০২০ সালের ৫৫তম বিশ্ব ইজতেমা। আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করবেন বাংলাদেশের তাবলিগের প্রধান মারকাজ কাকরাইলের মুরব্বি হাফেজ মাওলানা জোবায়ের আহমদ। 

যৌতুকবিহীন বিয়ে :
বিশ্ব ইজতেমায় এবার অন্যতম আকর্ষণ ছিল যৌতুকবিহীন বিয়ে। ২০১৬ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিশ্ব ইজতেমায় যৌতুকবিহীন বিয়ে বন্ধ ছিল। সম্পূর্ণ শরিয়ত মেনে তাবলিগের রেওয়াজ অনুযায়ি ইজতেমার দ্বিতীয় দিন শনিবার আছর নামাজের পর ইজতেমার বয়ান মঞ্চের পাশেই বসে যৌতুকবিহীন বিয়ের কনের সম্মতিতে বর ও উভয় পক্ষের লোকজনের উপস্থিতিতে বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। ইজতেমা শুরুর আগ মুহূর্ত থেকে অভিভাবকরা বর ও কনের নাম তালিকাভুক্ত করেন। বিয়ের পর বয়ান মঞ্চ থেকে মোনাজাতের মাধ্যমে নবদম্পতিদের সুখ-সমৃদ্ধিময় জীবন কামনা করা হয় এবং মঞ্চের আশপাশের মুসল্লিদের মাঝে খোরমা খেজুর দিয়ে মিষ্টিমুখ করানো হয়। 

যৌতুকবিহীন বিয়ের জন্য আছর নামাজের আগে ১০১ জনের নাম তালিকাভুক্ত হয়। বিয়েতে মোহরানা ধার্য করা হয় ‘মোহর ফাতেমী’র নিয়মানুযায়ী। এ নিয়ম অনুযায়ী মোহরানার পরিমাণ ধরা হয় ১৫০ তোলা রুপা বা এর সমমূল্য অর্থ ১ লাখ ৫ হাজার টাকা।

হিন্দু থেকে এক যুবকের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ :
শনিবার ইজতেমা ময়দানের উত্তর-পশ্চিম পার্শ্বে বিদেশি মেহমানদের কামরায় গাজীপুরের গাছা এলাকার বাসিন্দা রতন বসাক নামে এক যুবক কালেমা পড়ে হিন্দু ধর্ম থেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।

প্রথম পর্বের আখেরী মোনাজাতে অংশ নিতে সন্ধ্যা থেকেই দূর-দূরান্ত থেকে মুসল্লিরা ট্রেন, বাস, ট্রাক, লঞ্চ, নৌকাযোগে ও পায়ে হেঁটে দলে দলে ইজতেমাস্থলে আসতে শুরু করেছেন। ইজতেমা ময়দানে আসার এ স্রোত মোনাজাতের আগ পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে বলে জানান ইজতেমা আয়োজক কমিটি।

বয়ান :
ইজতেমার ময়দানে বয়ানে বিশ্বের ইসলামী চিন্তাবিদ ও বুজুর্গরা বলেন, দ্বীন ও ইসলামের দাওয়াত আল্লাহ পাকের অসীম রহমতে ও অনুগ্রহে তাবলীগ জামাতের মাধ্যমে সারা দুনিয়ায় দ্বীন ইসলাম পুনরুজ্জীবিত করে নর-নারীর মধ্যে তা পৌঁছে দেয়ার কাজে হযরত মোহাম্মদ (সা.) উম্মতের জিম্মাদার হিসাবে ঈমানিয়াত, ইবাদত, মোয়ামেলাত ও আখলাক অনুশীলনে জানমাল আল্লাহর রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে জিন্দেগিতে কিছু সময় দাওয়াত, তালিম, জিকির, নামাজে মশগুল হওয়া প্রয়োজন। বাংলা, আরবি, ফার্সি, উর্দুসহ কয়েকটি ভাষায় তাবলীগ জামাতের মুরুব্বিদের এসব বয়ান তরজমা করে মুসল্লিদের মাঝে শোনানো হচ্ছে। 

ফজর নামাজের পর বয়ান করেন ভারতের মাওলানা আব্দুর রহমান, জোহর নামাজের পর বয়ান করেন মাওলানা ইসমাইল, আছর নামাজের পর বয়ান করেন ভারতের মাওলানা জুহাইরুল হাসান এবং মাগরিবের নামাজের পর বয়ান করেন মাওলানা ইব্রাহিম দেওলা। এসব বয়ান বাংলাসহ বিভিন্ন ভাষায় তাৎক্ষণিক তরজমা করে মুসল্লিদের শুনানো হচ্ছে। 

বয়ানে মাওলানারা তাবলীগের ৬ উসুল নিয়ে আলোচনা করেন। তাবলীগের ৬ উসুল হচ্ছে- কালেমা, নামাজ, ইলম ও জিকির, ইকরামুল মুসলিমিন, সহিনিয়ত ও দাওয়াতে তাবলীগ। 

দাওয়াতে তাবলীগ বয়ানে মাওলানারা বলেন, দ্বিনের দাওয়াত চালু হয়ে গেলেই দুনিয়া ও আখিরাতে শান্তি পাওয়া যাবে, তারা আরো বলেন, আমাদের জিন্দেগি ও আখেরাতে শান্তি পেতে হলে বেশি বেশি চিল্লায় যেতে হবে। নিজে তাবলীগের কাজ করতে হবে ও অপর ভাইকে তাবলীগে আসার অনুপ্রেরণা দিতে হবে। ৩ দিনের জামাত, ৪০ দিনের জামাত তৈরি করতে হবে। 

আজ সারাদিন উপস্থিত তাবলীগ কর্মীদের মধ্যে থেকে যারা বিভিন্ন চিল্লায় যাবেন তাদেরকে তাশকিলের কামরায় জড়ো করা হয়।

ইজতেমায় আরো ৪ মুসল্লির মৃত্যু :
তিন দিনব্যাপী বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বে যোগ দিয়েছেন ৬৪ জেলার লাখ মুসল্লি। এবারের ইজতেমায় লোক সমাগম বেশি হওয়ায় মূল ময়দানে স্থান না পেয়ে রাস্তার পাশে তাঁবু টানিয়ে অবস্থান নিয়েছেন অনেকেই। ইজতেমায় এসে শুক্রবার রাতে আরও ৪ মুসল্লি মারা গেছেন। এনিয়ে এবারের বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিতে আসা ৯ মুসল্লি মারা গেছেন।

গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার মো. মনজুর রহমান জানান, শুক্রবার রাতে কুমিল্লার দেবিদ্বার থানার ডিমলা গ্রামের আবদুস সোবহানের ছেলে তমিজ উদ্দিন (৬৫), ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ থানার তোল্লা গ্রামের আব্দুস সাত্তারের ছেলে শাহজাহান (৬০), বরিশালের গৌরনদী থানার খালিজপুর গ্রামের হাতেম আলী বয়াতীর ছেলে আলী আজগর (৭০), নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানার দক্ষিণ কলাবাগান গ্রামের ওসমান গনির ইউসুফ মেম্বার (৪৫) হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।

এছাড়া শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজশাহীর চারঘাট থানার বনকির গ্রামের রহিম উদ্দিনের ছেলে আবদুর রাজ্জাক (৫০) হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা যান। 

রোববার ফজর নামাজের পর হেদায়েতি বয়ান করবেন পাকিস্তানি মাওলানা জিয়াউল হক। আখেরি মোনাজাতের আগে বিশেষ বয়ান করবেন ভারতের মাওলানা ইবরাহিম দেওলা। আখেরি মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে জোহরের নামাজের আগে। আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করবেন বাংলাদেশের তাবলিগের প্রধান মারকাজ কাকরাইলের মুরব্বি হাফেজ মাওলানা জোবায়ের আহমদ। 

আখেরি মোনাজাতের সময় যেসব সড়ক বন্ধ থাকবে :
বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের আখেরি মোনাজাত উপলক্ষে রোববার ভোর ৫টা থেকে বিমানবন্দর থেকে গাজীপুরের জয়দেবপুর, চৌরাস্তা, মিরেরবাজার-টঙ্গী, আবদুল্লাপুর থেকে বাইপাস সড়কে আশুলিয়া পর্যন্ত যান চলাচল বন্ধ থাকবে। শনিবার সকাল ১০টার দিকে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার আনোয়ার হোসেন গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানিয়েছেন।

পুলিশ কমিশনার বলেন, ইজতেমায় অংশ নেয়া কয়েক লাখ মুসল্লি ছাড়াও আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে ইচ্ছুক অসংখ্য মুসল্লির যাতায়াতের সুবিধার্থে ভোর ৫টা থেকে বিমানবন্দর-গাজীপুরের জয়দেবপুর, চৌরাস্তা, মিরেরবাজার-টঙ্গী, আবদুল্লাপুর থেকে বাইপাস সড়কে আশুলিয়ায় ব্যারিকেড দিয়ে ইজতেমাসংলগ্ন এলাকায় যান চলাচল বন্ধ রাখা হবে। ইজতেমা শেষে যাওয়ার সময় একই ব্যবস্থাপনা অব্যাহত থাকবে।

ইজতেমা ময়দানে জায়গা না পেয়ে রাস্তায় মুসল্লিদের অবস্থান :
বিশ্ব ইজতেমার ১৬০ একর আয়তনের সুবিশাল প্যান্ডেলের কোথাও ঠাঁই নেই। লাখো মুসল্লির পদচারণায় ইজতেমা ময়দান এখন জনসমুদ্র। মূল প্যান্ডেল তথা ময়দানের কোথাও ঠাঁই না পেয়ে মুসল্লিদের উপচেপড়া ভীড় আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। বৃহস্পতিবার রাত থেকেই ইজতেমা ময়দান ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় মুসল্লিদেরকে কনকনে শীত উপেক্ষা করে রাস্তায় পাটি বিছিয়ে শুয়ে পড়তে দেখা গেছে। 

ইজতেমা ময়দানের দক্ষিণ পাশে আশরাফ সেতু কারখানার ভেতরে অবস্থান নেয়া তাবলীগ জামাতের সাথী হাজী আবুল হোসেনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, তারা কুমিল্লা দেবিদ্বার থেকে এসেছেন। ইজতেমার মাঠে তাদের নির্ধারিত খিত্তায় জায়গা না পেয়ে এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। 

নওগাঁর বদরগাজী থানা থেকে আগত তাবলীগ জামাতের সাথী বৃদ্ধ খলিলুর রহমান জানান, তাদের ১৯ জনের একটি জামাত বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় ইজতেমা ময়দানে এসে পৌঁছে। তাদের এলাকার জন্য ময়দানের ৩৪ নম্বর খিত্তার ১৭ নম্বর খুঁটি নির্ধরিত ছিল। কিন্তু তারা নির্ধারিত ওই স্থানে গিয়ে বসা তো দূরের কথা দাঁড়ানোর জায়গাও পাননি। অবশেষে তারা সড়কের ফুটপাতে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। আরো পরে এলে ফুটপাতেও ঠাঁই হতো না। 

ফুটপাতে তারা যেখানে অবস্থান করছেন এর পেছনেই ইজতেমার ১০ নম্বর তিন তলা টয়লেট ভবন। টয়লেটের দুর্গন্ধ সহ্য করেই তাদেরকে বহু কষ্টে ফুটপাতে অবস্থান করতে হচ্ছে। 

সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ থেকে আসা সুলতান উদ্দিন জানান, তাদের এলাকা থেকে ৬৫ জনের একটি জামাত বুধবার রাত ১০টায় ইজতেমায় আসে। নির্ধারিত খিত্তায় স্থান সংকুলান না হওয়ায় অবশেষে তারা ফুটপাতে তাঁবু বিছিয়ে অবস্থান করছেন।

বিদেশি মুসল্লিদের অংশগ্রহণ :
ইজতেমার প্রথম পর্বে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব-আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, চাদ, ইথিওপিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত, পাকিস্তান, রাশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ আফ্রিকা, স্পেন, সুইজারল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, কাজাখস্তান, কিরগিস্তান, মালয়েশিয়া,  মরক্কো, নেপাল,  কেনিয়া, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, জর্দান, দুবাইসহ বিশ্বের ৬১টি দেশের  প্রায় ১ হাজার ৯শ বিদেশি মুসল্লি ইজতেমায় অংশ নিয়েছেন। বিভিন্ন ভাষাভাষী ও মহাদেশ অনুসারে ইজতেমা ময়দানে বিদেশি মেহমানদের ভিন্ন ভিন্ন তাঁবু নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

যানজট নিয়ন্ত্রণ :
রোববার আখেরী মোনাজাতে অংশ নিতে আসা মুসল্লিদের অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য দক্ষিণে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক  বিমানবন্দর, পশ্চিমে উত্তরা-১১ নং সেক্টর এবং গাজীপুর চৌরাস্তা ও মিরেরবাজার পর্যন্ত রাত ৩টা থেকে যানবাহন বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে বলে গাজীপুর জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।
 
গাজীপুরের ট্রাফিক বিভাগের সূত্রে জানা যায়, শনিবার রাত ৩টার পর থেকে রোববার আখেরি মোনাজাতের সময় পর্যন্ত ভোগড়া বাইপাস মোড় থেকে কুড়িল বিশ্বরোড, সাভারের বাইপাইল থেকে আব্দুল্লাহপুর পর্যন্ত অ্যাম্বুলেন্স ও পুলিশের গাড়ি ছাড়া সাধারণ যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। তবে মোনাজাতের দিন রোববার সকাল থেকে গাজীপুরের ভোগড়া বাইপাস মোড় এলাকা থেকে ইজতেমাস্থল পর্যন্ত  মুসল্লিদের সুবিধার্থে ইজতেমার স্টিকার লাগানো বাস চলাচল করবে।