বিকেলে ফসলী জমি, রাত পোহালে সকালে হয়ে যায় ডোবা।

ঘিওর (মানিকগঞ্জ) প্রতিনিধি। গতকালকেও ক্ষেতের করল্লা তুলে বাজারে বিক্রি করেছি। আজ সকালে খেত থেকে
করল্লা তুলতে গিয়ে দেখি আমার খেত আর নাই, ডোবা হয়ে গেছে। এই জমির আয়
দিয়ে আমাদের সংসার চলত। এখন আমার মাথায় বাড়ি।   আমাদের কিছু না জানিয়ে
রাতের আঁধারে মাটি লুট করে নিয়ে গেলো। এই বিচার কার কাছে দেবো?
এক রাতের ব্যবধানে ফসলী জমি ২০ ফুট গর্তের জলাভূমি করা জমির আইলে বুক
চাপড়ে কথাগুলি বলছিলেন কৃষক মোনছের আলী। পাশে  বিলাপ করছিলেন তার বোন
রাহেলা বেগম, লতা বেগম, ভাই মোনছের আলী, তমছের আলী, আনছার আলী, বরকত আলী।
এসময় ক্ষতিগ্রস্থ কমপক্ষে ২০ জন কৃষকের অভিযোগ টাকার প্রলোভন ও স্থানীয়
প্রভাবশালীদের ভয়ভীতির কারনে খুঁইয়েছেন তাদের ৩ ফসলী আবাদী জমি।
এভাবেই মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার বালিয়াখোড়া ইউনিয়নের ভালকুটিয়া,
পুখরিয়া, জোকা এলাকার তিন ফসলি কৃষিজমি থেকে রাতের আঁধারে কাটা হচ্ছে
মাটি। এসব মাটির শেষ ঠিকানা হচ্ছে পুখুরিয়ায় অবস্থিত স্টোন ব্রিকস নামের
এক ইটভাটায়। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এক টুকরো জমিও গুরুত্বের সাথে দেখতে
বলেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। এতে যেমন জমির উর্বরতা নষ্ট
হচ্ছে, তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্যও। সন্ধ্যা হতেই চলাচল
শুরু করে মাটিভর্তি শতাধিক ট্রাক। চলে রাতভর। মাটিবাহী ট্রাকের প্রভাব
পড়ছে সড়কগুলোতেও। মাটি ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য দিন দিন বেড়ে চলেছে।
গতকাল শুক্রবার সকালে সরজমিনে উপজেলার ভালকুটিয়া চকে দেখা গেছে, কৃষকের
অনুমতি ছাড়াই কয়েক বিঘা ফসলি জমির মাটি রাতের আঁধারে কেটে নিয়েছে
দুর্বৃত্তরা। খননকৃত ক্ষেতের পাশেই চিৎকার করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার
চাইছেন কৃষক ও কৃষাণীরা। জমির পাশেই ঠাই দাঁড়িয়ে রয়েছে (এক্সকাভেটর) মাটি
কাটার বিশাল খনন যন্ত্র ভেকু। পাশেই স্টোন ব্রিকস ইটভাটায় মাটির পাহাড়
জমে আছে। রাতে মাটি কাটার জন্যপেুরো চকজুড়ে আলোর ব্যবস্থা করে রেখেছেন।
ভালকুটিয়া গ্রামের বাসিন্দা আব্দুর রহমান, কুরমান, ঈমান আলী, আরমান বলেন,
এই চকে কয়েক শত বিঘা জমিতে ধান, ভুট্টা, করল্লা, মিষ্টি লাউ ও বিভিন্ন
সবজি লাগিয়েছেন স্থানীয় কৃষকেরা।  ভালকুটিয়া এলাকার মাটি ব্যবসায়ী
দেলোয়ার হোসেন, আওয়ামীলীগ নেতা দিলীপ বসু, আব্দুর রশিদসহ আরও কয়েকজন
প্রভাবশালী কৃষিজমি থেকে এক্সকাভেটর দিয়ে গভীর গর্ত করে মাটি কেটে বিক্রি
করছেন। এতে পাশের কৃষিজমির মাটি ভেঙে পড়ছে।  মাটিকাটা বন্ধ না করলে এই চক
থেকে কৃষিজমি হারিয়ে যাবে।
অভিযোগ উঠেছে, পরিবেশ আইন অমান্য করে স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে
দীর্ঘদিন যাবত এই চকের ফসলি জমির মাটি কাটা হচ্ছে। প্রথমে এলাকার চিহ্নিত
দালালরা লোভনীয় অফার দিচ্ছে কৃষকদের । রাজি না হলে দেখানো হচ্ছে ভয় ভীতি
। তাতেও যদি কৃষি জমির মাটি বিক্রিতে অনীহা দেখায় কৃষক, তাহলে রাতের
আঁধারে তাদের অনুমতি ছাড়াই কেটে নিচ্ছে এসব জমির মাটি।
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক আরজু মিয়া বলেন, রাহেলা বেগমের কাছ থেকে ১ লক্ষ টাকা
দিয়ে ৩৩ শতাংশ জমি গিরবী  নিয়ে চাষাবাদ করছিলাম।   সকালে খেতে করল্লা
তুলতে গিয়ে দেখি খেতে মাটি নাই। খেতের ফসল নষ্ট করে রাতের আধারে ভেকু
দিয়ে মাটি কেটে নিয়েছে দীলিপ, দেলোয়ার, রশিদ। জমির মালিককের সাথে কোন কথা
না বলেই তারা মাটি কেটে নিয়েছে।
ঘিওর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ মাজেদুল ইসলাম বলেন, ফসলি জমির উপরিভাগের
১০ থেকে ১২ ইঞ্চির মধ্যে মাটির জৈব উপাদান থাকে। সেই মাটি কাটা হলে জমির
জৈব উপাদান চলে যায়। এতে জমির স্থায়ী ক্ষতি হয়। ফসলি জমির মাটি কাটা
বেআইনি।
সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলার ভালকুটিয়া, পুখরিয়া, জোকা এলাকায়  ফসলি জমি
থেকে প্রতিদিনই মাটিকাটা হচ্ছে। মাটি ব্যবসায়ীরা ভেকু (এক্সকাভেটর) দিয়ে
১০ থেকে ২০ ফুট গভীর গর্ত করে মাটি নিয়ে যাচ্ছে। এসব গর্তে পাশের
কৃষিজমির মাটিও ভেঙে পড়ছে।
কৃষিজমি থেকে মাটি কেটে নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে মাটি ব্যবসায়ী আব্দুর
রশিদ বলেন, আমরা জমির মালিকদের কাছ থেকে মাটি কিনে স্টোন ব্রিকসের বিক্রি
করছি। জমির মালিকের অনুমতি ছাড়া কারো মাটি কাটার বিষয়টি আমার জানা নেই।
মাটির মূল ব্যবসার সাথে জড়িত আবুল বাশার (জেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগ সাধারন
সম্পাদক), এমপির চাচা তায়েবুর রহমান টিপু (জেলা আওয়ামীলীগের সাবেক
সাংগঠনিক সম্পাদক), জেলা আওয়ামীলীগের এক বড় নেতার মেয়ের জামাই রুবেল এবং আরো বড় বড় নেতারা। আপনি তাদের সাথে কথা বলেন।
মাটি ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেন বলেন, আমরা শুধু মালিকদের কাছ থেকে জমির
মাটি কিনে দেই। মাটির মূল ব্যবসা আবুল বাশার আর রুবেলের।
জেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগ সাধারন সম্পাদক আবুল বাশার সাংবাদিকদের বলেন, আমি নগদ টাকা
দিয়ে, নিয়ম মেনে ব্যবসা করি।  এ ব্যবসার স্থানীয় সহযোগীরা যদি কারো অনুমতি
না নিয়ে মাটি কেটে থাকে তাহলে তাদের সাথে কথা বলে ক্ষতিগ্রস্থ জমির
মালিকদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে দেবো।
স্টোন বিক্সস এর এজিএম অহিদুল ইসলাম রানা বলেন, আমরা মাটি কিনি ঠিকাদার
বাশারের কাছ থেকে।  তারা কিভাবে কোথা থেকে মাটি এনে দেয় তা আমার জানা
নেই।
ঘিওর উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা হামিদুর রহমান বলেন, এর আগে ভ্রাম্যমান
আদালত পরিচালনা করে মাটি কাটার সাথে জড়িতদের আটক ও জরিমানা করা হয়েছে।
জোড় করে মাটি কাটার অভিযোগ পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করবো।