আব্দুর রাজ্জাক, ঘিওর, মানিকগঞ্জ :
এক সময়ের প্রমত্তা কালীগঙ্গা নদী এখন মৃতপ্রায়। বর্ষা মৌসুম ছাড়া বছরের প্রায় পুরো সময়টাই থাকে পানিশূন্য। নদীর বুকজুড়ে ধু-ধু বালুচর, কোথাও চাষাবাদ, কোথাও গরু চরানো কিংবা দুরন্ত কিশোরদের ক্রিকেট ও ফুটবল খেলার দৃশ্য চোখে পড়ে। অথচ এ নদীর বুকে চলত জাহাজ। ৩ যুগ আগেও চলত বড় বড় ফেরি ও লঞ্চ। তরা-বানিয়াজুড়ির সেই নৌরুটের কথা এখনো অনেকের মনে আছে। নৌরুটটি পদ্মা-যমুনার আরিচা-দৌলতদিয়া বা আরিচা-নগরবাড়ি রুটের চেয়ে খুব বেশি ছোট ছিল না।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, মানিকগঞ্জের বুক চিড়ে বয়ে গেছে পদ্মা, যমুনা, কালীগঙ্গা, ধলেশ্বরী, ইছামতীসহ মোট ১১টি নদী। জেলার মোট আয়তন ১ হাজার ৩৭৯ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ২৪১ কিলোমিটার নদী এলাকা। কালীগঙ্গার দৈর্ঘ্য ৭৮ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ২৪২ মিটার। এই নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বহু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। জানা গেছে, দৌলতপুরের চর কাটারি এলাকায় যমুনা থেকে উৎপন্ন হয়ে কালীগঙ্গা ঘিওর উপজেলার আশাপুরের পাশ দিয়ে জাবরা, দুর্গাপুর ও তরা এলাকায় ধলেশ্বরীর সাথে মিশেছে। এখান থেকে গালিন্দা, নবগ্রাম, চরঘোসতা, আলীগর চর, শিমুলিয়ায় এসে পদ্মার সাথে মিশেছে। বর্তমানে এখান থেকে আরো খানিকটা এগিয়ে হাতিপাড়া, বালুখন্দ, পাতিলঝাপ, শল্লা হয়ে আলী নগরে এসে ধলেশ্বরীতে মিশেছে।
আশির দশকের শুরুর দিকেও কালীগঙ্গা দিয়ে বড় বড় ফেরি-লঞ্চ চলতে দেখা গেছে। আর আজ কালিগঙ্গার বুকে পানির অস্তিত্ব নেই বলইে চলে। বৃহৎ এ নদীটির দুরবস্থার কারণে শুধু নৌযান চলাচলই বন্ধ হয়নি, নদীতে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করা হাজার হাজার জেলে পরিবারেও চলছে দুর্দিন। নদীতে দেশীয় মাছ বিলুপ্তির পথে। অনেকেই মাছ ধরার পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন। যারা পেশা বদল করতে পারেননি তাদের জীবন কাটছে মানবেতর ভাবে।
নদী মরে যাওয়ার ফলে কৃষিনির্ভর এ এলাকার সেচ কাজও দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। মানিকগঞ্জ সদর ও ঘিওর উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, সদরের বেউথা, বান্দুটিয়া, পৌলী ও ঘিওর উপজেলার তরা, উত্তর তরা, কালিগঙ্গায় বিশাল বিশাল চর পড়েছে। চরে আবাদ হচ্ছে ফসলের। অনেক জায়গায় চলছে নদী দখলের নানা কর্মযজ্ঞ। জামাল উদ্দিনের বয়স প্রায় ৮২ বছর। উত্তর তরা নদীর পাড়ে তার বাড়ি। বৃদ্ধ জামাল উদ্দিন বলেন, ‘১৫-২০ বছর আগেও এত খারাপ অবস্থা ছিল না। এই নদী এক সময় বাড়ির পাশে ছিল। মাছ ধরতাম, গোসল করতাম। ঘরের কাজ, কৃষিকাজ সব নদীর পানি দিয়েই করতাম। এখন আর নদীতে পানি নেই। বেশির ভাগ জায়গা ভরাট হয়ে গেছে, দখল হয়ে গেছে।’ আরেক কৃষক ইসমাইল বলেন, ‘নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় সেচ কাজে পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। কৃষিকাজ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’ কালীগঙ্গা নদী পাড়ের মির্জাপুর গ্রামের সঞ্জিত রাজবংশী বলেন, আমরা বাপ দাদার আমল থেকে এই নদী থেকে মাছ ধরে বিক্রি করে সংসার চালাতাম। বর্ষাকাল ছাড়া নদীতে পানি থাকে না। নদীতে পানি নেই তো মাছ নেই। বিগত ৭/৮ বছর যাবৎ তাই এই পেশা ছেড়ে দিয়েছি। জীবিকার তাগিদে এখন অটো বাইক চালিয়ে সংসার চালাই।
জাবরা গ্রামে বাড়ি মাজেদা বেগমের (৫৫)। তিনি বলেন, ‘এক সময় নদীর পানি রান্নার কাজে ব্যবহার করা যেত। এখন বর্ষা মৌসুম ছাড়া নদীতে পানিই থাকে না। সেই পানিও কল-কারখানার বর্জ্যে দূষিত হয়ে গেছে।’ বাংলাদেশ কৃষক সমিতি জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বলেন, আগে নদীর পানি ব্যবহার করে জমিতে সেচ দেয়া হতো। এখন পানির সঙ্কটে কৃষিকাজ ব্যাহত হচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানিই একমাত্র ভরসা। ঘিওর উপজেলা প্রাণিসম্পদ সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মোঃ ফারুক হোসাইন বলেন, মাছ, জলজ পতঙ্গ, পাখিসহ অনেক প্রাণী নদীর ওপর নির্ভরশীল। নদী শুকিয়ে গেলে, বিলুপ্ত হয়ে যাবে তারাও৷ কমবে মাছের প্রজনন৷
ঘিওর উপজেলার দক্ষিণ তরা এলাকার রমজান আলী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন বলেন, নদীর উত্তর পাড়ে তরা ও বেউথা ব্রিজ এলাকায় অবৈধভাবে নদী দখল করে ভরাট করেছের ব্যবসায়ীরা। দুই পাড়েই নদীর ওপর গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান।
মানিকগঞ্জ পরিবেশ রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব লক্ষী চ্যাটার্জি বলেন, কালিগঙ্গা নদীতে বেশ কয়েকটি বড় ব্রিজ নির্মাণের ফলে নদীর কিছু অংশ সংকুচিত হয়ে গেছে। এছাড়াও অবৈধ দখল এবং পলিতে ভরাট হয়ে গেছে নদী। নদী খনন করে এরপানি প্রবাহের ধারা অব্যাহত রাখতে দ্রুত কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ নেয়া জরুরী, নইলে জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বেব বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করেন।
মানিকগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক নুর আলম বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি হল নদী আর এর জন্যই এদেশের জমি যথেষ্ট উর্বর। সেই নদীই যদি শুকিয়ে যায়, তবে তা কৃষি, পরিবেশ ও অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। তিনি আরো বলেন, প্রতিবছর নদী ভাঙ্গনের ফলে মাটি ও পলিতে নদীটি ভরে যাচ্ছে। সেই সাথে অবৈধভাবে দখল, অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন এবং বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে নদী শাসনের ফলে নদীর এই দৈণ্যদশা।
মানিকগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মাইন উদ্দিন বলেন, পানির প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে নদী খননের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ইতিমধ্যে বিআইডব্লিউটিএ এর আওতায় কালিগঙ্গা খনন কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়াও কালিগঙ্গা নদী ভাঙ্গন রোধে ও স্বাভাবিক স্রোতধারা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে একটি মেগা প্রকল্প আগামী একনেকে পাস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।