করোনার প্রতাপে নদীতে কমেছে দূষণ। গাছের সবুজেও এসেছে গভীরতা। কিন্তু প্রকৃতির এই সুদিনেও ভালো নেই চট্টগ্রামের হালদা নদীর ডলফিন। কক্সবাজারের টেকনাফে একটি ডলফিন হত্যার কয়েকদিনের মধ্যেই আরেকটিকে হত্যা করা হয়েছে চট্টগ্রামের হালদা নদীতে। ৫২ কেজি ওজনের এই ডলফিনকে হত্যার পর ধারালো ছুরি দিয়ে কেটে চর্বি বের করে নেওয়া হয়েছে।
এদিকে হালদায় ডলফিন হত্যা বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সোমবার ‘ভার্চুয়াল’ আদালতে একটি রিট আবেদন করা হয়েছে।
ডলফিনের চর্বি বের করে নেওয়ার নতুন চেষ্টাকে ‘অশনিসংকেত’ হিসেবে দেখছেন গবেষকরা। তারা বলছেন, গত আড়াই বছরে শুধু এই হালদা নদীতেই প্রাণ হারিয়েছে ২৪টি ডলফিন। অথচ সারাবিশ্বের বিভিন্ন নদীতে এই গাঙ্গেয় বা গাঙ্গেস ডলফিন আছে মাত্র এক হাজার ১০০ থেকে এক হাজার ২০০টি। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) তাই এই ডলফিনকে অতি বিপন্ন প্রজাতির লাল তালিকায় রেখেছে।
নদী গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মঞ্জুরুল কিবরিয়া বলেন, চট্টগ্রামের স্থানীয় ভাষায় ডলফিন ‘উতোম’ কিংবা ‘শুশুক’ নামে পরিচিত। আইইউসিএনের লাল তালিকায় থাকলেও এখানকার বিভিন্ন নদীতে একের পর এক ডলফিন আঘাতজনিত কারণে মারা যাচ্ছে। চর্বি সংগ্রহের জন্য সর্বশেষ যে ডলফিনটি এখানে হত্যা করা হয়েছে সেটির দৈর্ঘ্য প্রায় সাত ফুট। এটি অশনিসংকেত।
মঞ্জুরুল কিবরিয়া জানান, তারা চট্টগ্রাম রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে হালদায় মৃত ডলফিনগুলোর পোস্টমর্টেম করে নিশ্চিত হয়েছেন, বেশিরভাগ ডলফিনই মারা যাচ্ছে আঘাতজনিত কারণে। ডলফিন ওজনে অনেক ভারী হলেও এর শরীরে মাংসপেশী নেই। প্রতিরোধ ক্ষমতাও অত্যন্ত দুর্বল। তাই একটু আঘাত পেলেই এটি কাবু হয়ে যায় এবং শরীরে পচন ধরে। ডলফিনের মৃত্যুর কারণ জানতে বাংলাদেশে এবারই প্রথম পোস্টমর্টেম করে দেখা হচ্ছে। এতে ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর ও ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সাতটি প্রতিষ্ঠান যুক্ত ছিল।
এদিকে কর্ণফুলীর মোহনা থেকে ৪৩ কিলোমিটার নদীপ্রবাহকে চারটি জোনে ভাগ করে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ও হালদা নদীতে বিচরণরত একটি পুরুষ গাঙ্গেয় ডলফিন দুই দশমিক ১২ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। পুরুষের চেয়ে নারী ডলফিন কিছুটা বড় হয়। ধূসর রঙের এই প্রজাতির ডলফিন ২৫ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত বাঁচে। তবে এদের জন্মহার কম। নদীকেন্দ্রিক বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প ছাড়াও ইঞ্জিনচালিত নৌযান, ড্রেজারসহ নানা যান চলাচলে এদের আবাসস্থল ও জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্স অ্যান্ড ফিশারিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলাম, পরিবেশ ও বনবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আল-আমিন এবং মেরিন সায়েন্স অ্যান্ড ফিশারিজ বিভাগের অধ্যাপক আয়েশা আক্তার এই গবেষণা পরিচালনা করেন।
হাটহাজারীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রুহুল আমিন বলেন, ‘হালদা নদী দখল ও দূষণমুক্ত রাখতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছি। দূষণে জড়িত কয়েকটি কারখানা বন্ধও করা হয়েছে। তারপরও বাঁচানো যাচ্ছে না বিপন্ন এই প্রাণীকে।’ যোগদানের ১৯ মাসের মধ্যে শুধু হালদাতেই ৪-৫টি ডলফিন পেয়েছেন জানিয়ে মোহাম্মদ রুহুল আমিন বলেন, গত ৮ মে কেটে ক্ষতবিক্ষত করা ডলফিনটি মদুনাঘাট ব্রিজের পাশে পানি শোধনাগার প্রকল্পের বিপরীত পাশে পাওয়া গেছে। কর্ণফুলী ও হালদার মোহনায় কারও জালে আটকা পড়ার পর এটিকে সম্ভবত হত্যা করা হয়েছে।
ডলফিন হত্যা বন্ধে ভার্চুয়াল কোর্টে প্রথম রিট :হালদায় ডলফিন হত্যা বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ‘ভার্চুয়াল’ আদালতে একটি রিট আবেদন করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আব্দুল কাইয়ুম লিটন। গতকাল সোমবার ইমেইলের মাধ্যমে বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের হাইকোর্ট বেঞ্চে এ রিট আবেদনটি জমা দেন তিনি। আবেদনে হালদা নদীতে ডলফিন হত্যা বন্ধে বিবাদীদের নিষ্ফ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ হবে না এবং ডলফিন হত্যা বন্ধে কেন প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হবে না- এ মর্মে রুল জারির আর্জি জানানো হয়েছে। আবেদনে মৎস্য ও পশুসস্পদ সচিব, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক ও চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে বিবাদী করা হয়েছে।
সূত্র- সমকাল