প্রকৌশলী এ,এন,এম এনায়েত উল্লাহ, ২৮ মার্চ।
করোনা ভাইরাস নিয়ে আমরা সবাই আতঙ্কিত ৷ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে ইতালি, স্পেন, এবং অ্যামেরিকা সহ আরো অনেক উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ যেভাবে প্রতিদিন সংক্রমিত হচ্ছে আর  মৃত্যুর মিছিল নামছে তা দেখে আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছি, ভাবি এই মহামারি আমাদের দেশে শুরু হলে কী হবে পরিস্থিতি! এবং যে যেভাবে পারছে বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমে পরামর্শ দিচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে যদিও  এর পক্ষে কোন প্রমাণ্য দলিল নেই৷ তবু আতঙ্কিত হয়ে সংক্রমণ থেকে নিজেকে সর্বোত্তম রক্ষার জন্য যে যেভাবে পারছি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছি৷ এতে করে পরিবার সমাজ সকলেই একটা অস্থিরতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছি৷ আমরা মনগড়া কিছু ধারণা থেকে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহন করছি৷ তাহলে আসুন দেখি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কী বলে! আর আমাদের বিশ্বাসের সাথে মিলিয়ে দেখি; ভেবে দেখি কী করা উচিত৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কতগুলো সাধারণ ধারণা বা কৌতুহল নিবৃত করার চেষ্টা করেছে এবং পরামর্শ দিয়েছে ৷ আসুন সেগুলি দেখে নেই ( WHO এর ওয়েব সাইট থেকে অনূদিত )
১. কভিড -১৯ ভাইরাসটি গরম এবং আর্দ্র আবহাওয়াযুক্ত অঞ্চলে সংক্রমণ হতে পারে কি?
পারে৷ এখনও পর্যন্ত প্রাপ্ত প্রমাণ হচ্ছে যে, কভিড -১৯ ভাইরাসটির গরম এবং আর্দ্র আবহাওয়া বিশিষ্ট  অঞ্চলগুলি সহ সমস্ত অঞ্চলে সংক্রমণ হতে পারে। জলবায়ু নির্বিশেষে, আপনি যেখানেই বসবাস করেন, করোনামুক্ত বা  কভিড -১৯ এ আক্রান্ত  কোনও অঞ্চলে ভ্রমণ করা অবস্থায়  প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করুন,  কভিড -১৯ থেকে নিজেকে রক্ষার সর্বোত্তম উপায় হ’ল ঘন ঘন আপনার হাত পরিষ্কার করা। এটি করে আপনি আপনার হাতের ভাইরাসগুলি নির্মূল করেন এবং সংক্রমণ এড়াতে পারেন৷ হাত দ্বারা আপনার চোখ, মুখ এবং নাক স্পর্শ করার ফলে আপনার দেহে করোনা সংক্রমণ  ঘটতে পারে।
২.শীতল আবহাওয়া এবং তুষার নতুন করোনভাইরাসকে হত্যা করতে পারে কি?
শীতল আবহাওয়া নতুন করোনভাইরাস বা অন্যান্য রোগকে মেরে ফেলতে পারে বলে বিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই। বাহ্যিক তাপমাত্রা বা আবহাওয়া নির্বিশেষে মানবদেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা প্রায় ৩৬.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৩৭° ডিগ্রি সেলসিয়াস অবধি থাকে। নতুন করোনাভাইরাস থেকে নিজেকে রক্ষা করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হ’ল অ্যালকোহল ভিত্তিক স্যানিটাইজার দিয়ে  হাত ঘষে হাত ঘন ঘন সাফ এবংপানি দিয়ে ধুয়ে ফেলা।
৩. গরম পানিতে গোসল করলে নতুন করোনভাইরাস রোগ প্রতিরোধ করে, গরম স্নান করলে আপনাকে কভিড -১৯ দ্বারা আক্রান্ত হওয়া থেকে বিরত রাখবে কি?
না৷  আপনার স্নানের বা ঝরনার তাপমাত্রা নির্বিশেষে আপনার স্বাভাবিক শরীরের তাপমাত্রা প্রায় ৩৬.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড থেকে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে থাকে। এ তাপমাত্রা ভাইরাসকে মারতে পারেনা৷ আসলে, অত্যন্ত গরম পানি দিয়ে গরম গোসল করা ক্ষতিকারক হতে পারে, কারণ এটি আপনাকে পোড়াতে পারে। কভিড -১৯ থেকে নিজেকে রক্ষার সর্বোত্তম উপায় হ’ল ঘন ঘন হাত পরিষ্কার করা। এটি করে আপনি আপনার হাতের ভাইরাসগুলি নির্মূল করেন এবং সংক্রমণ এড়াতে পারেন এবং তা না হলে আপনার চোখ, মুখ এবং নাক স্পর্শ করার মাধ্যমে সংক্রমণ ঘটতে পারে।
৪. নতুন করোনাভাইরাস মশার কামড়ের মাধ্যমে সংক্রমিত হতে পারে কি?
 না ৷ আজ অবধি কোনও তথ্য বা প্রমাণ পাওয়া যায় নি যে নতুন করোনাভাইরাসটি মশার মাধ্যমে সংক্রমণ হতে পারে। নতুন করোনাভাইরাস একটি শ্বাসযন্ত্রের ভাইরাস যা প্রাথমিকভাবে সংক্রামিত ব্যক্তির কাশি বা হাঁচি হয় বা নাক থেকে লালা বা স্রাবের ফোঁটাগুলির মাধ্যমে উৎপন্ন ফোঁটাগুলির মাধ্যমে ছড়ায়। নিজেকে রক্ষা করতে, অ্যালকোহল-ভিত্তিক স্যানিটাইজারে মাধ্যমে  আপনার  হাত ঘন ঘন পরিষ্কার করুন বা সাবান এবং পানিতে ধুয়ে ফেলুন। এছাড়াও, কাশি এবং হাঁচি হয় এমন কারও সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ এড়িয়ে চলুন।
৫. হ্যান্ড ড্রায়ারগুলি কি নতুন করোনভাইরাস হত্যার ক্ষেত্রে কার্যকর? 
না। হ্যান্ড ড্রায়ারগুলি কভিড-১৯ হত্যায় কার্যকর নয়। নতুন করোনভাইরাস থেকে নিজেকে রক্ষা করতে, ঘন ঘন অ্যালকোহল ভিত্তিক স্যানিটাইজার দ্বারা আপনার হাত পরিষ্কার করা উচিত বা সাবান এবং পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলা উচিত। একবার আপনার হাত পরিষ্কার হয়ে গেলে আপনার হাত টিস্যু পেপার বা উষ্ণ এয়ার ড্রায়ার ব্যবহার করে সেগুলি ভাল করে শুকানো উচিত।
৬. একটি অতিবেগুনী রশ্মি বাতি জীবাণুমুক্তকরণ  করতে বা নতুন করোনভাইরাসকে হত্যা করতে পারে কি? 
হাত বা ত্বকের অন্যান্য ক্ষেত্রগুলিকে জীবাণুমুক্ত করার জন্য ইউভি (আল্ট্রা-ভাওলেট) ল্যাম্প ব্যবহার করা উচিত নয় কারণ ইউভি রেডিয়েশনের ফলে ত্বকের জ্বালা হতে পারে।
৭. নতুন করোনভাইরাসে আক্রান্ত লোকদের সনাক্ত করতে তাপ স্ক্যানারগুলি কতটা কার্যকর? 
নতুন করোনাভাইরাস সংক্রমণজনিত কারণে জ্বর প্রকাশ পেয়েছে এমন লোকদের সনাক্তকরণে তাপীয় স্ক্যানার কার্যকর (যখন শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রার চেয়ে বেশি)। তবে, সেগুলি সেসমস্ত সংক্রামিত লোকদের সনাক্ত করতে পারে না যারা  এখনও জ্বরে আক্রান্ত হননি। কারণ আক্রান্ত ব্যক্তিরা জ্বরে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হতে ২ থেকে ১০ দিনের মত সময় লাগে। 
৮. সারা শরীরে অ্যালকোহল বা ক্লোরিন স্প্রে করে নতুন করোনভাইরাসকে মেরে ফেলা যায় কি?
 না। আপনার সারা শরীরে অ্যালকোহল বা ক্লোরিন স্প্রে করলে আপনার শরীরে ইতোমধ্যে প্রবেশ করেছে এমন ভাইরাসকে হত্যা করবে না। এই জাতীয় পদার্থ স্প্রে করা কাপড় বা শ্লেষ্মা ঝিল্লির জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে (অর্থাৎ চোখ, মুখ)। সচেতন থাকুন যে অ্যালকোহল এবং ক্লোরিন উভয়ই পৃষ্ঠতলের জীবাণুমুক্ত করতে কার্যকর হতে পারে তবে যথাযথ ব্যাক্তির সুপারিশের ভিত্তিতে  ব্যবহার করা দরকার।
৯. নিউমোনিয়ার বিরুদ্ধে ভ্যাকসিনগুলি কী নতুন করোনভাইরাস থেকে রক্ষা করে? 
না,  নিউমোনিয়ার বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন যেমন নিউমোকোকাল ভ্যাকসিন এবং হিমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ বি (এইচআইবি) ভ্যাকসিনগুলি নতুন করোনভাইরাস থেকে সুরক্ষা দেয় না। ভাইরাসটি এত নতুন এবং আলাদা যে এর নিজস্ব ভ্যাকসিন প্রয়োজন। গবেষকরা কভিড -১৯  এর বিরুদ্ধে একটি ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা করছেন এবং WHO তাদের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করছে। যদিও এই ভ্যাকসিনগুলি কভিড -১৯  এর বিরুদ্ধে কার্যকর নয় তবে আপনার স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য শ্বাসকষ্টজনিত অসুস্থতার বিরুদ্ধে টিকা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়।
১০. স্যালাইন দিয়ে নিয়মিত আপনার নাক ধুয়ে ফেলা কি নতুন করোনভাইরাস সংক্রমণ রোধে সহায়তা করতে পারে? 
না।  নিয়মিত স্যালাইন দিয়ে নাক ধুয়ে ফেলা মানুষকে নতুন করোনভাইরাস সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করেছে এমন কোনো প্রমাণ নেই। কিছু প্রমাণ রয়েছে যে নিয়মিত স্যালাইন দিয়ে নাক ধুয়ে ফেলা লোকজনকে সাধারণ সর্দি থেকে আরও দ্রুত আরোগ্যলাভে সহায়তা করতে পারে। তবে  নিয়মিত নাক ধুলে  শ্বাসকষ্টজনিত সংক্রমণ রোধ করতে পারে এমনটি দেখা যায়নি
১১. রসুন খাওয়া নতুন করোনভাইরাস সংক্রমণ রোধ করতে সাহায্য করতে পারে? 
রসুন একটি স্বাস্থ্যকর খাবার যাতে কিছু অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে। তবে, এখনকার প্রাদুর্ভাবে রসুন খাওয়া মানুষকে নতুন করোনভাইরাস থেকে রক্ষা করেছে তার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি ৷
১২. নতুন করোনভাইরাস কি বয়স্ক ব্যক্তিদেরকে বেশী আক্রমণ করে এবং  অল্প বয়সীরা বেশী ঝুঁকিতে?
 নতুন করোনভাইরাস দ্বারা সকল বয়সের লোকেরা আক্রান্ত হতে পারে। বয়স্ক ব্যক্তিরা এবং যারা আগে থেকেই  বিভিন্ন রোগ যেমন হাঁপানি, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ইত্যাদিতে আক্রান্ত ছিলেন তাঁরা ভাইরাসে মারাত্মকভাবে অসুস্থ হওয়ার ক্ষেত্রে আরও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে বলে মনে হয়। ডাব্লুএইচও সকল বয়সের লোকদের ভাইরাস থেকে নিজেকে রক্ষা করার পদক্ষেপ নিতে পরামর্শ দেয়, উদাহরণস্বরূপ  হাতের ভাল হাইজিন এবং শ্বাস প্রশ্বাসের স্বাস্থ্য হাইজিন অনুসরণ করা৷
১৩. অ্যান্টিবায়োটিকগুলি কি নতুন করোনভাইরাস প্রতিরোধ এবং চিকিৎসার জন্য কার্যকর?
 না, কেবল ব্যাক্টেরিয়া ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিকগুলি ভাইরাসগুলির বিরুদ্ধে কাজ করে না ৷ নতুন করোনাভাইরাস  একটি কভিড -১৯ ভাইরাস এবং তাই, অ্যান্টিবায়োটিকগুলি প্রতিরোধ বা চিকিৎসার উপায় হিসাবে ব্যবহার করা উচিৎ নয়। তবে, যদি আপনি করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন তবে আপনি অ্যান্টিবায়োটিকগুলি গ্রহণ করতে পারেন কারণ করোনা আক্রান্তের ব্যাকটিরিয়ার আনুষঙ্গিক ইনফেকশনের সম্ভবনা আছে৷
১৪. নতুন করোনভাইরাস প্রতিরোধ বা চিকিৎসার জন্য কোনও নির্দিষ্ট ওষুধ রয়েছে কি? 
আজ অবধি নতুন করোনভাইরাস কভিড -১৯  প্রতিরোধ বা চিকিৎসার জন্য কোনও নির্দিষ্ট ওষুধ নেই। তবে ভাইরাসে আক্রান্তদের লক্ষণগুলি থেকে মুক্তি এবং চিকিৎসা করার জন্য যথাযথ যত্ন নেওয়া উচিৎ এবং গুরুতর অসুস্থতায় আক্রান্তদের অনুকূল-সহায়ক যত্ন নেওয়া উচিৎ। কিছু নির্দিষ্ট চিকিৎসা তদন্তাধীন, এবং ক্লিনিকাল ট্রায়ালের মাধ্যমে পরীক্ষা করা হবে। WHO একটি নির্দিষ্ট পরিধিতে বা অংশীদারদের সাথে গবেষণা এবং উন্নয়নের প্রচেষ্টা ত্বরান্বিত করতে সহায়তা করছে।