আব্দুর রাজ্জাক
শীতের পাখায় ভর দিয়ে প্রতি বছরের মতো এবারও নিলুয়া বিলে অতিথি পাখির আগমন ঘটেছে। ফলে বিভিন্ন এলাকা থেকে পাখিপ্রেমীরা দল বেঁধে আসছেন পাখি দেখতে। মানিকগঞ্জের নিলুয়া বিল। বিলটির অবস্থান মানিকগঞ্জের দুই উপজেলা ঘিওর এবং দৌলতপুরের ঠিক মাঝখানে।
শীতকাল এলেই এই নিলুয়া বিল অতিথি পাখির কিচির মিচির শব্দে মুখরিত হয়ে উঠে। খুব বড় না হলেও বিলটি পাখির কারণে বেশ পরিচিতি লাভ করেছে। পাখির বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি, উড়েচলা, নীরবে বসে থাকা- মানুষকে আকৃষ্ট করে। তাই দূরদূরান্ত থেকে লোকজন একনজর পাখি দেখার জন্য এখানে আসেন।
সরজমিন গত শনিবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, শান্ত জলের
বুকে কচুরিপানার সবুজ গালিচার মাঝে ঝাঁক বেঁধে ডানা মেলছে অতিথি পাখির দল।
উড়ে চলা পাখির কিচির-মিচিরে মুখরিত চারিপাশ। মানিকগঞ্জের এই নিলুয়া বিল
প্রতিবছর শীত মৌসুমে হয়ে উঠে যেন পাখির আবাসস্থল। এবারও এ বিলে আবাস
বেঁধেছে বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন পাখিসহ হাজারো অতিথি পাখি।
তাদের মধ্যে ‘পাতি সরালি’র সংখ্যাই বেশি। পরিমানে গত বছরের চেয়ে বেশি,
এমনটাই জানালেন স্থানীয়রা।
স্থানীয় সূত্র জানায়, পিয়াংহাঁস, পাতি
সরালি, রাজসরালি, গ্যাডওয়াল, লেঙজা হাঁস, বালিহাঁস, পাতিকূট, দেশী জাতের
শামুকখোল, পানকৌড়ি, ছন্নিহাঁসসহ বিভিন্ন প্রজাতির নাম নাজানা অতিথি পাখি,
বিল এলাকা মুখরিত করে তুলছে। এ বছর তিব্বতীয় মানিকচক, সাইবেরিয়ান ফিদ্দাসহ
অনেক নতুন অতিথি পাখি চোখে পড়ে।
দলবেঁধে যখন পাখিগুলো আকাশে ওড়ে, তখন মনে হয় তারা যেন মালার মতো দুলে উঠছে। যদিও বিলটিতে এখন পানি অনেকটাই কমে গেছে, তবুও এর সৌন্দর্য কমেনি এতটুকুও। বিলের এক পাড় সিসি বস্নক বসানো হয়েছে। বিকালে বয়স্ক ও তরুণ-তরুণীরা পাখি দেখে মোবাইল ফোন সেটে সেলফি তুলে, পাশাপাশি ফুসকা-চটপটি খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে।
স্থানীয় বাসিন্দা মোঃ মাহবুব হোসেন বলেন, মূলত নভেম্বর মাসের শেষের দিকে অতিথি পাখিরা এখানে আসতে থাকে। আবার মার্চের শেষ দিকে ফিরে যায় আপন ঠিকানায়। ৬/৭ বছর পূর্বে এই বিলে প্রথম অতিথি পাখি আসে।
সাভার থেকে সপরিবারে পাখি দেখতে আসা নাসরিন শিকদার বলেন, শীতের সময় নিলুয়া বিলে পাখিদের মেলা বসে। পাখি দেখতে সপরিবারে চলে আসছি। এবার পাখির সংখ্যা অনেক। দারুন উপভোগ করছি।
নিলুয়া এলাকার মঞ্জু রহমান বলেন, বছর দুয়েক কয়েকজন শিকারী এখান থেকে পাখি শিকার করার পর, পাখির সংখ্যা কমতে শুরু করে। কিন্তু চলতি বছর দ্বিগুণ পাখির আনাগোনা বেড়েছে। প্রতিদিন দূর দূরান্ত থেকে অনেক মানুষ এখানে পাখি দেখতে আসেন। এ উপলক্ষ্যে ৪ মাস এখানকার দোকানপাটগুলে তে বেচাকেনা বেড়ে যায়।
মানিকগঞ্জ জেলা পরিবেশ রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব লক্ষী চ্যাটার্জ্জী বলেন, “অতিথি পাখিদের বিচরণ নিরাপদ করার জন্য অতিথি শিকার ও বিক্রয় বন্ধ করতে হবে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন-২০১২ অনুযায়ী পাখি শিকার, হত্যা, আটক ও ক্রয়-বিক্রয় দন্ডনীয় অপরাধ। যার শাস্তি ২ বছর কারাদ- এবং ২ লক্ষ টাকা জরিমানা। আর আমরা যার যার অবস্থান থেকেই পারি এসব বিষয়ে সবাইকে সচেতন করার। একটূ সচেতনতাই পারে আমাদের দেশটাকে অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখরিত করে রাখতে।
ঘিওর উপজেলা প্রাণিসম্পদ সম্প্রসারণ কর্মকর্তা ডাঃ মোঃ ফারুক হোসাইন বলেন, পাখি প্রকৃতির অলংকার। এ অলংকার ধ্বংস করা মানে পরিবেশ ধ্বংস করা। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার জন্য পাখির বিচরণ ক্ষেত্র মুক্তভাবে রক্ষা করতে হবে। অতিথি পাখিরা যেন ‘মুক্ত আকাশে, খালে, বিলে, হাওড় বাঁওড়ে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে তার ব্যবস্থা অবশ্যই আমাদের করতে হবে।
ঘিওর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ হামিদুর রহমান বলেন, প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার জন্য পাখির বিচরণ ক্ষেত্র মুক্তভাবে রক্ষা করতে হবে। আমাদের দেশ ক্রমে ক্রমে অতিথি পাখির জন্য ঝুঁকি পূর্ণ হয়ে উঠছে। শুধু আইন দিয়েই পাখি শিকার বন্ধ করা যাবে না, এজন্য প্রয়োজন সবার সচেতনতা ও প্রাণী প্রেম। বিলটির উন্নয়ন ও অতিথি পাখির নিরাপদ অভয়াশ্রম করার লক্ষ্যে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবগত করেছি। সংশ্লিষ্ট দফতরে এ ব্যাপারে একটি প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো হবে।