প্রতিষ্ঠার প্রায় ১১ বছর পর হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ নতুন কমিটি পেয়েছে। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফীর ইন্তেকালের পর গত রবিবার গঠিত কেন্দ্রীয় এই কমিটির আমির ও মহাসচিব শীর্ষ দুই পদেই এসেছে নতুন মুখ। সেই সঙ্গে ১৫১ সদস্যের নতুন কমিটি গঠনের পর দেশের অরাজনৈতিক ধর্মীয় বৃহৎ এই সংগঠনের নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত হলেও কমিটিতে বাদ পড়াদের মধ্যে ক্ষোভ দানা বাঁধছে। দেখা দিয়েছে হতাশা।
গত রবিবার চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদরাসায় অনুষ্ঠিত সম্মেলনে বিলুপ্ত হওয়া গত কেন্দ্রীয় কমিটির নায়েবে আমির, যুগ্ম মহাসচিবসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে যাঁরা ছিলেন কিন্তু নতুন কমিটিতে বাদ পড়েছেন, তাঁদের নিয়ে যেকোনো সময় পাল্টা কমিটি ঘোষণার আভাস মিলেছে। এ নিয়ে দুই দিন ধরে চট্টগ্রাম ও ঢাকার বিভিন্ন স্থানে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন পদবঞ্চিতরা। এসব বৈঠকে পরবর্তী করণীয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে পাল্টা সম্মেলন করা হতে পারে। সম্মেলন করা না গেলে শুধু সংবাদ সম্মেলন করে পাল্টা কমিটির ঘোষণা আসতে পারে।
পাল্টা নেতৃত্বে হেফাজতের গত কমিটিতে থাকা অনেককেই গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখার চিন্তা করছেন বাদ পড়া নেতারা। যেসব কওমি মাদরাসা থেকে বর্তমান কমিটিতে কেউ পদ পাননি, তাঁদেরও রাখা হতে পারে। তবে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের পাল্টা কমিটির শীর্ষ পদে না রাখার ছক কষছেন বঞ্চিত নেতারা। এ ক্ষেত্রে বিতর্ক এড়াতে আলেম-উলামাদের মধ্যে যাঁরা অরাজনৈতিক ব্যক্তি, তাঁদেরই শীর্ষ পদে রাখার চিন্তা করছেন।
এদিকে হেফাজতের পাল্টা কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের লক্ষ্যে পদবঞ্চিতদের অগ্রসর হওয়ার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না নতুন কমিটির নেতারা। তাঁরা বলছেন, মূলধারার বাইরে গিয়ে পাল্টা কমিটি করা হলে তাঁদের কোনো গুরুত্ব থাকবে না। ওই কমিটি আলেম-উলামাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।
হেফাজতের নতুন কমিটিতে পদ না পাওয়া একাধিক নেতা জানান, নতুন কমিটিতে কোনো কারণ ছাড়াই হেফাজতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা আমিরের অনুসারীদের বাদ দেওয়া হয়েছে। একতরফা কমিটি ঘোষণা করে হেফাজতকে ভাঙার চেষ্টা করা হচ্ছে। এটি আলেম-উলামারা মেনে নেবেন না। উদ্দেশ্যমূলকভাবে যাঁদের বাদ দেওয়া হয়েছে তাঁরাসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়েই অচিরেই সংগঠনের একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করা হবে।
হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটির নবনির্বাচিত সহসাংগঠনিক সম্পাদক মীর ইদরীস বলেন, হেফাজতে ইসলাম একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। বড় সংগঠনে সবাইকে পদায়িত (পদ) করা সম্ভব না। সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন যে কমিটি হয়েছে, তা গঠনতন্ত্র মেনে এবং সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও কাউন্সিলে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে হয়েছে। মূলধারার বাইরে গিয়ে কেউ সফল হয় না। কেউ কমিটি করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না।
এদিকে নতুন কমিটি গঠনকে অগণতান্ত্রিক ও অগঠনতান্ত্রিক আখ্যা দিয়ে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস বলেন, আহমদ শফীর মৃত্যুতে শুধু শূন্য আমির পদ পূরণ হওয়ার কথা। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, কাউন্সিল করতে হলে নির্বাহী কমিটির অনুমোদন নিতে হবে। তা না করে আগের কমিটি বিলুপ্ত করে নতুন কমিটি করা হয়েছে, যা অগণতান্ত্রিক। বিএনপি জোটের সাবেক এই এমপি জানান, নায়েবে আমির হওয়ার পরও তাঁকে কাউন্সিলে ডাকা হয়নি।
হেফাজতের নতুন কমিটি প্রত্যাখ্যান করে সদ্য বিলুপ্ত কমিটির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মঈনুউদ্দিন রুহী বলেন, হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আমির আল্লামা শফীর নীতি-আদর্শের বাইরে গিয়ে এবং হেফাজতের গঠনতন্ত্রের ধারা লঙ্ঘন করে গঠিত কমিটি অবৈধ। আলেম-উলামারা এই কমিটি প্রত্যাখ্যান করেছেন। সম্মেলন যিনি আহ্বান করেছেন, তিনি কমিটির সদস্য পদেও নেই। এখানে ২০ দলীয় জোটের একটি শরিক দলের শীর্ষ নেতাকে মহাসচিব করা হয়েছে। এটি সংগঠনবিরোধী। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আজকে (সোমবার) ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকায় একটি বৈঠক আছে। আমরা এখনো আশা করছি, বাবুনগরীসহ সবাই ভুল (নতুন কমিটি) বুঝতে পারবেন। আল্লামা শফীর নীতি-আদর্শকে সামনে রেখে এবং গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তাঁরা সবাই আমাদের সঙ্গে আসবেন।’
হেফাজতে ইসলাম সূত্রে জানা গেছে, যেকোনো সময় পাল্টা কমিটির ঘোষণা আসতে পারে। এই কমিটিতে স্থান পেতে পদবঞ্চিতদের অনেকে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। চট্টগ্রাম থেকে মহাসচিব করা হলে ঢাকা থেকে আমির করা হতে পারে। আবার ঢাকা থেকে কাউকে মহাসচিব করলে চট্টগ্রাম থেকে আমির পদে রাখা হবে।
হেফাজতের আগের কমিটির নায়েবে আমির ছিলেন ইসলামী আন্দোলনের আমির তথা চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ রেজাউল করীম। নতুন কমিটিতে তাঁকে রাখা হয়নি। সরকার সমর্থক হিসেবে পরিচিত আলেম মাওলানা ফরীদ ঊদ্দীন মাসঊদ, মাওলানা রুহুল আমিন দুটি কওমি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান। কিন্তু তাঁদের কওমি মাদরাসাভিত্তিক হেফাজতে নেওয়া হয়নি। তবে বাকি চার বোর্ডের প্রতিনিধিরা আছেন কমিটিতে। হেফাজতের নতুন কেন্দ্রীয় কমিটিতে আল্লামা শফীর বড় ছেলে মাওলানা ইউসুফ মাদানীকে সদস্য পদে রাখা হলেও ছোট ছেলে গত কমিটির প্রচার সম্পাদক পদে থাকা মাওলানা আনাছ মাদানী বাদ পড়েছেন। গতকাল সোমবার একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও আনাছ মাদানী সংযুক্ত হননি।
হেফাজতের পাল্টা কমিটির শীর্ষ পদে আসতে পারেন এমন কয়েকজনের নাম দুই দিন ধরে শোনা যাচ্ছে। এর মধ্যে গত কেন্দ্রীয় কমিটিতে নায়েবে আমির পদে থাকা বেফাকের সাবেক মহাসচিব মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস, সাবেক সংসদ সদস্য মুফতি ওয়াক্কাস, মাওলানা আবুল হাসনাত আমিনী, মুফতি নুরুল আমিন, মাওলানা সলিমউল্লাহ, সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ ও মাওলানা মঈনুউদ্দিন রুহী, প্রচার সম্পাদক মাওলানা আনাছ মাদানী উল্লেখযোগ্য।
বাদ পড়া একাধিক নেতা অভিযোগ করেন, হেফাজতের নতুন কমিটিতে জমিয়তে উলামায় থেকে ৩৫ জন, মজলিস থেকে ২২ জন এবং খেলাফত থেকে ছয়জনকে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া কয়েকজন নেতার পরিবার থেকে একাধিক সদস্যকেও কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদ দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত রবিবার চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদরাসায় অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় সম্মেলনে প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব হাফেজ জুনাইদ বাবুনগরী নতুন আমির নির্বাচিত হন। এ ছাড়া সম্মেলনে নতুন মহাসচিব নির্বাচিত হন গত কেন্দ্রীয় কমিটির নায়েবে আমির ও ঢাকা মহানগর হেফাজতে ইসলামের আমির নূর হোসাইন কাসেমী।