বিশেষ প্রতিনিধি
নদীতে প্রবল স্রােত, মাওয়ায় ফেরি সার্ভিস বন্ধ, যানবাহনের চাপ বৃদ্ধি এবং ফেরি স্বল্পতা ও স্্েরাতের কারণে ফেরি চলাচলে সময় বেশী লাগার কারণে গত কয়েকদিন ধরে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটের ফেরি সার্ভিস। যাত্রীবাহীবাস, ব্যক্তিগতগাড়ী পারের সুযোগ বেশী থাকার কারণে পন্যবাহি ট্রাক দিনের পর দিন অপেক্ষা করেও পার হতে পারছে না। পন্যবাহি ট্রাক পারের জন্য তিনদিন চারদিন অপেক্ষা করে টিকিট মিললেও ফেরিতে ওঠার জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে গড়ে ৬ থেকে ৭ ঘন্টা। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে পাটুরিয়া ঘাটে পারের জন্য আসা শত শত পন্যবাহি ট্রাকের শ্রমিকরা।
ট্রাক চালক শেখ মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন বলেন, গত সোমবার রাতে ঢাকা থেকে রওয়ানা দিয়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বাথুলী স্কেলের কাছে ১দিন এবং উথলী মোড়ে ১দিন মহাসড়কের ওপর পুলিশ গাড়ি আটকিয়ে রাখার ২দিন পর পাটুরিয়া ট্রাক টার্মিনালে পৌঁছাই। পাটুরিয়া ট্রাক টার্মিনালে তিনদিন ধরে ফেরি পারের অপেক্ষায় রয়েছি। রাস্তায় দু’দিন এবং ঘাটে আসার পর ৩দিন অতিবাহিত হলেও রোববার সকাল পর্যন্ত তিনি ফেরি টিকিট পায়নি।
আরেক ট্রাক চালক হাফেজ আলী বলেন, তিনি চার দিন ধরে পাটুরিয়া ট্রাক টার্মিনালে ফেরি পারাপারের জন্য অপেক্ষা রয়েছে। একবার বৃষ্টিতে ভিচ্ছি আবার রোদে পুরছি, জীবনটা শেষ। চারটা দিন ধরে এখানে রোদে বৃস্টিতে পুরছি আমাদের ফেরি কর্তৃপক্ষের একটু সহানুভুতি দেখানো উচিত।
ট্রাকচালক আবুল কালাম বলেন, সব গাড়ি এক সাথে পারাপারি কওে টার্মিনাল থেকে বের হতে গিয়ে ভাংচুর হচ্ছে। ফেরি আসার পর গাড়ি বুক দিয়ে এরপর ফেরি ছেড়ে দিবে। এছাড়া কর্ত্যরত পুলিশ বলেন, এখান দিয়ে যাইতে পারবা না, ওখান দিয়ে যাইতে পারবা না। এমন যদি হয় তাহলে আমরা যাবো কোথায় দিয়ে? এদিকে কুরিয়ার সার্ভিস গাড়িসহ বিভিন্ন ধরনের কাভার্টভ্যান ঘাটে এসে অনায়াসে পার হয়ে যাচ্ছে তারা মানুষ, আমরা কি মানুষ না ? আমরা ট্রাক চালকরা ৪/৫দিন ধরে টার্মিনালে আটকা পড়ে আছি। আমি পাটুরিয়া ট্রাক টার্মিনালে ৫দিন ধরে আটকে আছি কি খাবো কি করবো বুঝতাছি না ? এখানে কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। কর্তৃপক্ষের অব্যশই এগুলো দেখা উচিত।

আরেক চালক হাসেম আলী বেলেন, ফোনে ফোনে গাড়ি পার হচ্ছে। কিন্ত আমরা সিরিয়াল নিয়ে টার্মিনালে দিনের পর দিন বসে আছি। আমরা স্কেল করে পার হতে পারছি না কিন্ত ডানে-বামে অনেক গাড়িই ইর্মাজেন্সি দেখিয়ে পার হয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থা অব্যাহত থাকলে এবার তাদের কোনবানির ঈদ করা কষ্ট হয়ে পড়বে বলে জানিয়েছেন ট্রাক শ্রমিকরা। করোনার কারণে গাড়ির ভাড়া কম আবার গাড়ির ট্রিপ সংখাও কমে যাচ্ছে।
ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বোয়ালী ব্রীজের কাছে আটকে থাকা ট্রাক শ্রমিক হালিম মিয়া বলেন, শনিবার রাত ৯টায় ট্রাক নিয়ে এই ফাঁকা স্থানে আছেন। এখানে কোন হোটেল নেই আমরা ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করতে পারছি না।ফাঁকা জায়াগায় রাতের বেলায় মালামাল চুরি হওয়ে যাওয়ার ভয়ে ঘুমাতে পারছি না। খুব কষ্টে আছি আমরা। হালিমের মতো আটকে পড়া অনেক চালকরাই একই রকম কষ্টের কথা জানালেন তারা।
সরজমিনে পাটুরিয়া ঘাট ঘুরে যেটা দেখা গেছে, পাটুরিয়া ঘাটের মুল টার্মিনালটি গাড়িতে কানায় কানায় পরিপূর্ন পা ফেলানোর জায়গা নেই। কিন্তু লঞ্চ ঘাটের উত্তর পার্শ্বের ট্রাক টার্মিনালটি ফাঁকা রয়েছে। ঘাট এলাক থেকে পাটুরিয়া-ঢাকা মহাসড়কের দু’পাশে যানবাহনের দীর্ঘ সাড়ি দেখা গেছে। এক সাড়িতে যাত্রীবাহী বাস অপর সাড়িতে পণ্যবাহী ট্রাক রয়েছে। আরসিএল মোড় থেকে নালী বাজারের রাস্তা হয়ে ৫নং ঘাট এলাকা পর্যন্ত মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকারসহ ছোট গাড়ির দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে। ফেরি পার হতে ঘাটে আসা এসব যানবাহনগুলোকে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
পাটুরিয়া ট্রাক টার্মিনাল ট্রাক শ্রমিক নিজেরাই সিরিয়াল ব্যবস্থা পরিচালনা করার চেষ্ট করছে। কিন্তু অন্যান্য ট্রাক শ্রমিকরা তা মানতে চাচ্ছে না। ফলে এসব স্থানে চলছে চরম বিশৃংখলা। টার্মিনাল থেকে গাড়ি বের হওয়ার পথে কোন ট্রাফিক ব্যবস্থা না থাকায় ট্রাক শ্রমিকরা কোন সিরিয়াল মানছে না। এরা পারাপারি এবং হুরমুর করে এক সাথে টার্মিনাল থেকে বের হয়ে ফেরিতে ওঠার চেষ্টা করছে। এতে এক গাড়ির সাথে আরেক গারির সংঘর্ষ হচ্ছে ও চাপ লেগে গাড়ির গ্লাস ভেঙ্গে যাচ্ছে এবং বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশংকা করছেন অনেকে। এনিয়ে প্রতিনিয়তই ট্রাক শ্রমিকদের মধ্যে জটলা বাঁধছে।
এদিকে ঘাট এলাকায় যানজট মুক্ত রাখতে পণ্যবাহী ট্রাকগুলোকে পাটুরিয়া ঘাটে প্রবেশ করতে না দিয়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বাথুলী এলাকায় এবং উথলী মোড় থেকে আরিচা ঘাটের দিকে মহাসড়কের উপর সাড়ি বদ্ধভাবে আটকিয়ে রাখছে পুলিশ। রোববার সকালে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের উথলী মোড় থেকে আরিচা ঘাট পর্যন্ত ৪ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে পণ্যবাহী ট্রাকের সাড়ি দেখা গেছে। মুল্যবান পণ্য নিয়ে এভাবে খোলা আকাশের নীচে মহাসড়কের ওপর ফাঁকা জায়গায় থাকতে চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন এসব ট্রাক শ্রমিকরা। এছাড়া খাবার সংকট ও প্রকৃতির ডাকে সারা দেওয়াসহ নানা ধরনের অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে রাস্তার ওপর আটকে থাকা ট্রাক শ্রমিকদেরকে।
পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে গত কয়েকদিন ধরে ফেরি সার্ভিসে এ অচলাবস্থা চলছে এব্যাপারে শিবালয় সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তানিয়া সুলতানা সাংবাদিকদেও বলেন, ৫/৬দিন ধরে ফেরি পারের জন্য অপেক্ষা করছে চালকদের এ কথা সঠিক নয়। প্রয়োজনীয় সংখ্যক পুলিশ ও আনসার ঘাট এলাকায় যানবাহন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। সিরিয়ালের বাইরে ফেরিতে যানবাহন পারের কোন রকম সুযোগ নেই। সকল ধরনের গাড়িই সিরিয়াল মোতাবেক পার করা হচ্ছে। তবে যাত্রীবাহী বাস, প্রাইভেটকার মাইক্রোবাস, এ্যাম্বুল্যান্সসহ পঁচনশীল জরুরী পণ্যবাহী ট্রাকগুলোকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিত্বে পার করা হচ্ছে।
বিআইডব্লিউটিসি’র আরিচা আঞ্চলিক কার্যালয়ের ডিপুটি জেনারেল ম্যানেজার জিল্লুর রহমান বলেন, মাওয়ায় ফেরি সার্ভিস বন্ধ, যানবাহনের চাপ বৃদ্ধি, ফেরি সংকট এবং নদীতে প্রবল স্রােতের কারণে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে ফেরি সার্ভিসের এ অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে ৬টি রো-রো এবং ৭টি ইউটিলিটি ফেরি রয়েছে এ নৌরুটে। ঈদুল আযহার জন্য তাদের যথেষ্ট প্রস্তুুতি রয়েছে। ঈদের সময় ফেরি সংখ্যা বাড়ানো হবে। আরো দু’টি রো-রো ফেরি এ বহরে যোগ হলে এ সমস্যা থাকবে না বলে তিনি জানান।