উপমহাদেশের মুসলিম সমাজে যে কয়টি দিবস অত্যন্ত মাহাত্ম্যপূর্ণ ব্যবস্থাপনায় উৎসবমুখর পরিবেশে উদযাপনের প্রচলন রয়েছে তন্মধ্যে একটি হলো ‘ফাতেহা-ই-ইয়াযদাহম’। এখানে ‘ফাতেহা’ শব্দের অর্থ- মৃত ব্যক্তির কল্যাণ কামনায় বা মাগফেরাতের জন্য দোয়া, দুরুদ ইত্যাদি পাঠ করা।ইয়াযদাহম শব্দটি ফারসি, অর্থ- এগারো। পারিভাষিক অর্থমতে, বড়পীর আবদুল কাদের জিলানী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর ওফাত দিবসকে কেন্দ্র করে যে দোয়া, মিলাদ-মাহফিলের আয়োজন করা হয় তাকেই উপমহাদেশের মুসলমানগণ ‘ফাতেহা-ই-ইয়াযদাহম’ চিহ্নিত করেন।
‘উপমহাদেশ’ শব্দটি ব্যবহার করার কারণ হচ্ছে, উপমহাদেশের বাহিরে উল্লেখসংখ্যক দেশে বড়পীর আবদুল কাদের জিলানীর ওফাত দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় পালন করা হলেও দিবসটি ‘ফাতেহা-ই-ইয়াযদাহম’ পরিভাষায় পরিগণিত হয় কি- না তা যথেষ্ট অনুসন্ধানের বিষয়।
ভারত উপমহাদেশে যে হাজার বছর ধরে সুফি সম্প্রদায়ের একচ্ছত্র আধিপত্য বিরাজ করছে তা অস্বীকারের সুযোগ নেই— শিক্ষিত এবং সজাগ কোনও ব্যক্তির পক্ষে তা অস্বীকারের দুঃসাহস দেখানোরও অবকাশ নেই। আর এটা তো অত্যন্ত স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত, প্রকৃত সুফিমাত্রেরই গাউসে পাক আবদুল কাদের জিলানীর প্রতি বিশেষ ভক্তি, অনুরাগ থাকবে— একজন সুফির সিলেবাসে এটি একটি আবশ্যিক অংশও। সুফি-সিলেবাসের এ আবশ্যিক অংশের সূত্র ধরে বলা যায়, সুফিমাত্রেই স্ব স্ব অবস্থান ও গণ্ডিতে গাউসে পাকের ওফাত দিবসটি অত্যন্ত গুরুত্বসহ পালনের মাধ্যমে স্মরণ করেছেন, করছেন।
উপমহাদেশে ‘ফাতেহা-ই-ইয়াযদাহম’ পালনের অগ্রপথিক হিসেবে বাবা আদম শহীদ (রহ.)- কে গণ্য করা হয়।
জনশ্রুতি রয়েছে, ১১৭৪ খ্রিস্টাব্দে গাউসে পাকের ৮ম ওফাত দিবসে বাবা আদম শহীদের নির্দেশক্রমে তার খলিফা হজরত মুয়াবিন আল-বসরির মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জের তৎকালীন খানকায় ‘ফাতেহা-ই-ইয়াযদাহম’ ঘটা করে পালিত হয়। সেখানে গরু জবাই করা হয়েছিল বিধায় রাজা বল্লাল সেন তার খলিফা হজরত মুয়াবিন আল-বসরিকে কূপে নিক্ষেপ করে হত্যা করে এবং মূলত এ কারণেই রাজা বল্লাল সেন ও বাবা আদম শহীদের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি হয়-যার ঐতিহাসিক স্বীকৃতিতে প্রায় সমস্ত ইতিহাসবিদ অকৃপণ।
কেবল উপমহাদেশেই নয় বরং সমগ্র বিশ্বের সুফি-সম্প্রদায়ভুক্ত সমাজ দিবসটিকে গুরুত্বের সাথেই নানান ধর্মীয় পদ্ধতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে উদযাপন করে থাকেন। তবে সকলের সাথে বাঙালি মুসলমানদের ভিন্নতা হচ্ছে, তারা দিবসটিকে নিজেদের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে ‘ফাতেহা-ই-ইয়াযদাহম’ পরিভাষায় সাদরে বরণ করেছেন এবং তার স্থায়িত্বও নিশ্চিত করতে পেরেছেন- যা বাংলাদেশের খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ও বিশ্লেষক মুনতাসীর মামুনের ‘স্মৃতিময় ঢাকা’ গ্রন্থে স্পষ্টবাক্যে তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন- ‘গত শতকের শেষ দশকে নবাব সলিমুল্লাহ মুসলমানদের প্রধান আরেকটি উৎসব হিসেবে ফাতেহা-ইয়াজদহম তুলে ধরেন। এ উপলক্ষে ঢাকা শহরের প্রতিটি পঞ্চায়েতকে তিনি টাকা দিতেন। এই টাকা ব্যয় করা হতো দুটি খাতে। প্রথমে মহল্লা সাজানো, দ্বিতীয় মিলাদ পড়ানো। এ মিলাদেরও বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল- এটি পরিচিত ছিল ‘ভাটিয়ালি মৌলুদ’ নামে। হয়ত ভাটিয়ালি সুরে পড়ানো হতো বলেই এই নাম। নাছির আহমেদ, সলিমুল্লাহর সময়ে এক ‘স্পেশাল মিলাদ’ এর কথা উল্লেখ করেছেন। এছাড়াও ফাতেহা-ইয়াজদমের সময়, পঞ্চায়েতসমূহ চকের মসজিদ সুন্দরভাবে সাজিয়ে উচ্চস্বরে সেখানে মিলাদ পড়াবার বন্দোবস্ত করতো।”
মুনতাসীর মামুনই নন, কবি সুফিয়া কামালও তার ‘একালে আমাদের কাল’ স্মৃতিগ্রন্থে ফাতেহা-ই-ইয়াযদাহমকে মুসলিম সমাজের সংস্কৃতিরূপে উল্লেখ করে লিখেছেন- ‘‘বড়পীর সাহেবের ওফাত-দিবস রবিউসসানীর ১১ তারিখে শিরনী হতো। গোসল করে পাক সাফ হয়ে সে শিরনী রাঁধতে হত। সারা পাড়ার মানুষ সে শিরনী পাক সাফ হয়ে খেয়ে যেতো।”
এমনভাবে অনুসন্ধান চালালে বিখ্যাত আরও অনেকের স্মৃতিকথাতেই বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতির অংশ হিসেবে ফাতেহা-ই-ইয়াযদাহমকে অনড় অবস্থানে পাওয়া যাবে। এক্ষেত্রে এ তথ্যটি উল্লেখ করা অপরিহার্য, বৃটিশ সরকারের আমলে মুসলমানদের জন্য যে গুটিকয়েকদিন ছুটির জন্য বরাদ্দ ছিল তন্মধ্যে একটি হলো ফাতেহা-ই-ইয়াযদাহম। এতে চূড়ান্তভাবে সন্দেহমুক্ত হয়ে বলা যায়, তৎকালীন নিজেদের বিপর্যস্ত সময়েও বাঙালি মুসলিম সমাজ নিজেদের সাংস্কৃতিক অংশ হিসেবে দিবসটিকে সমাদর করতে কোনওরূপ কার্পণ্য করেনি।
সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের মতো বাংলা সাহিত্যেও গাউসে পাক আবদুল কাদের জিলানী একটি অবিচ্ছিন্ন বিষয়। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি আলাওল কাদেরিয়া তরিকার একজন খলিফা ছিলেন। কবির ‘সিকান্দরনামা’ গ্রন্থের ‘কবির আত্মকথা’ শিরোনামে অত্যন্ত স্পষ্টাক্ষরে তা লিখিত আছে। মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ কবিদের মধ্যে গণ্য, রচনাপ্রাচুর্যে পূর্ববঙ্গের প্রধান কবি হেয়াত মামুদও তার রচনাতে গাউসে পাকের স্তুতির অবতারণা করেছেন একাধিক জায়গায়।
ভাষা গবেষণায় অনবদ্য ব্যক্তিত্ব, জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ গাউসে পাকের একটি তথ্যবহুল জীবনী এবং ‘কাসিদা গাউসিয়া’র সার্থক কাব্যানুবাদ করেছেন। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদের মধ্যে প্রথম মহাকাব্য রচয়িতা কবি কায়কোবাদ অন্তিমমুহূর্তে তার মুর্শিদের নির্দেশনায় গাউসে পাক আবদুল কাদের জিলানীর বৃহদাকারে কাব্যজীবনী লিখেছেন, যা কবি তনয়া জাহানারা বেগমের তত্ত্বাবধানে ১৯৭৯ সালে ‘গওছ পাকের প্রেমের কুঞ্জ’ নামে প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, “আমার পিতার ইচ্ছায় ও নির্দেশক্রমে এই গ্রন্থের সমুদয় আয় সেগুনবাগানে অনুষ্ঠিত হজরত গওছ পাকের বাৎসরিক ওরশ শরীফে ব্যয়িত হইবে।”— যা গাউসে পাকের প্রতি মহাকবি কায়কোবাদের ভক্তিপূর্ণ ভালোবাসার চির-প্রকাশস্থল।
বাংলা সাহিত্যে নির্মল ইসলামী ভাবধারার একক প্রতিষ্ঠাতা কবি ফররুখ আহমদের রচনাতেও গাউসে পাক প্রসঙ্গ ‘গাউসুল আজম’ শিরোনামে স্বতন্ত্র উজ্জ্বলতায় সমুদ্ভাসিত।
জীবদ্দশায়ই পিএইচডি’র বিষয়বস্তু বনে যাওয়া মরমি-কবি সাবির আহমেদ চৌধুরী একাধিক সঙ্গীতে গাউসে পাকের কীর্তনগাঁথা রচেছেন। এভাবেই বাঙলা সাহিত্যের অন্দর-বাহিরে গাউসে পাকের সরব উপস্থিতি একান্ত লক্ষ্যণীয়।
বর্তমানে আমাদের দেশের ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াতেও ‘ফাতেহা-ই-ইয়াযদাহম’ প্রসঙ্গটি বলিষ্ঠতার সহিত প্রচার করা হয়। রবিউস সানির চাঁদ নিয়ে জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির বৈঠক থেকেই প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে ফাতেহা-ই-ইয়াযদাহম উদযাপনের ইংরেজি তারিখ ঘোষণা একটি প্রথারূপে দাঁড়িয়ে গেছে।
মূলধারার প্রায় সকল গণমাধ্যম ঘটা করে ‘ফাতেহা-ই-ইয়াযদাহম’র সংবাদ প্রকাশ এবং টেলিভিশনের দর্পণ থেকে এ সম্বন্ধে দর্শকদের সজাগবার্তা প্রেরণে কি আমাদের বাঙালি মুসলমানের সাংস্কৃতিক পরিচয়টাই মূর্ত হয়ে ফুটে উঠে না?
দেশের বাসিন্দাদের সাংস্কৃতিক উপলক্ষ সম্বন্ধে দেশবাসীকে সচেতন ও এর প্রচারণার দায়বদ্ধতার জায়গা থেকেই কিন্তু মিডিয়াজগৎ ‘ফাতেহা-ই-ইয়াযদাহম’ প্রসঙ্গে এতটা তৎপর এবং সরব। আর ‘ফাতেহা-ই-ইয়াযদাহম’ উদযাপন উপলক্ষে সরকারের ছুটি তো দিবসটিকে বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতির প্রশ্নে সর্বপ্রকার সমালোচনার বাণে বিদ্ধ করা থেকে রক্ষা করতে ‘কার্যকরী বর্ম’ হিসেবে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।